তাঁর জন্মদিনে বাড়িতে এসেছিলেন উত্তম কুমারও
গত মাসেই জীবন-নাট্য থেকে বিদায় নিয়েছেন বাঙালি থিয়েটার-চলচ্চিত্র প্রেমীদের অতি প্রিয় বর্ষীয়ান অভিনেতা মনোজ মিত্র। আজ রবিবার তাঁর জন্মদিন। বাংলা নাটকের ‘সাজানো বাগান’-এ অবশ্য তিনি চিরদিনই থেকে যাবেন।
নাটক লেখা,পরিচালনা এবং অভিনয় সবেতেই তিনি তাঁর পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। পর্দাতেও অগণিত চরিত্রের মধ্যে ‘বাঞ্ছারাম’ অবশ্যই কিংবদন্তি হয়ে থেকে গেল। তার চরিত্রগুলো যেন সংকটেও কখনো রসবোধ হারিয়ে ফেলে না।
কলকাতায় ফিরে তার সল্টলেকে বৈশাখীর দোতলা বাড়ির বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে তিনি দিব্যি আড্ডা দিচ্ছিলেন। সবুজ ভরা নিরালা শান্ত পরিবেশেই থাকতে ভালোবাসতেন বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় এই বর্ষিয়ান অভিনেতা তথা নাট্যকার মনোজ মিত্র। তাঁর সঙ্গে বিদেশ থেকেও ফোন করে অনেক কথা হয়েছে। তা যেন কখনই ভুলতে পারিনা।
চা খেতে খেতে অনেক কথার মাঝে একবার জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম উত্তম কুমারকে কেমন লাগতো! চওড়া হাসিমুখে উনি জানিয়েছিলেন “উত্তম কুমার ওরে বাবা! সে সুদর্শন পুরুষ”। আসলে প্রতিভার তো শেষ হয় না, কম্পিটিশন ছিল সেসময় তবু সেকালে শালীনতার অভাব ছিল না। বর্ষিয়ান এই অভিনেতার টকটকে ফর্সা বলিরেখার আঁচড়ে আমার মনে তখন একসময়কার মনোজ মিত্রের নায়কচিত চেহারা ঘুরে ফিরে আসছিল বারংবার। মনে হচ্ছিলো তিনি বরাবরই চিরসবুজ, সুন্দর ব্যক্তিত্বের আড়ালে নির্ভেজাল একটা মানুষ । টাটকা ছিল ওনার স্মৃতির পাতাগুলো। মেয়ে ময়ূরী মিত্রও বাবার মতোই একজন নাট্যব্যাক্তিত্ব। বাবা মেয়েকে একসাথে পেয়ে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো সেদিন, এত বিরাট মানের অভিনেতা হয়েও অতি সাধারণ ভাবে মানুষের সাথে কিভাবে মিশে যেতে পারেন সেদিনেই বুঝেছিলাম। প্রকৃতির নিয়মে চামড়ায় বয়সের ভাঁজ পড়লেও চলন আর কথাবার্তায় ‘বাঞ্চারাম’ ছিল বেশ স্পষ্ট, আভিজাত্য দিয়ে মোরা। আমি হতবাক হয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম অভিনয়টা ছিল ওনার ভাবনায়, অভিনয়টা রপ্ত করতে পেরেছিলেন সহজে। তাই চোখে মুখে তা যেন ফুটে উঠছিলো ।
বারংবার ছুটে গেছি ওনাদের বাড়ি। কথা বার্তার আড়ালে কখন আপন গিয়েছিলাম ওনার পরিবারের সাথে বুঝতেই পারিনি ওনারাও বুঝতে দেননি কখনো। ময়ূরীদি মিষ্টি মনের মানুষ।সম্পর্কর বন্ধন বেশ চলছিল। হঠাৎই যেন ছন্দপতন হলো ‘বাঞ্চারামে’র বাগানে, আলো নিভলো। দীর্ঘদিনের অসুস্থতা নিয়ে নাট্যকার এর চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হয় বৈকি!
বাঙালির আছে ভুরি ভুরি কিন্তু মনোজ মিত্র ছিলেন সকলের অগোচরে। আচ্ছা,বাঙালি কি বোঝে নি সেদিন! আর কোথাই বা গেল সেই বাঞ্চারাম! নতুন আর তৈরী হলো না তো? নাকি ডিজিটাল এর পেজে সেদিনের ‘নেকড়ে’ ‘সাজানো বাগান’ নাটক আর দেখানোই হয়না! বুঝলাম ‘বাঞ্চারাম’ কেবল একজনই হয় দশজন তা পারে নাকি,এত সহজে তার ‘সাজানো বাগান’ এ যে কেউ ফুল ফোটাতে পারে !
শুনেছিলাম ইন্দ্রাস্ট্রিতে ওনার সো কল্ড গড ফাদার কেউ ছিল না কিন্তু কম্পিটিশন ছিল ভয়ানক। তাই হয়তো উত্তম, সৌমিত্র, পাহাড়ি সান্যাল ছবি বিশ্বাস,জহর গাঙ্গুলীর পাশাপাশি সেদিনকার মনোজ মিত্র নামটা উঠছিলো তরতড়িয়ে।’শত্রু’ সিনেমার একটা অংশের অভিনয় নিয়ে কৌতুহলী হয়ে জানতে চেয়েছিলাম। যাত্রা-থিয়েটার দেখেই নাকি একদিন তৈরী হয়েছিল ‘ সুন্দরম’ কিংবা ‘গন্ধর্ব’র অমূল্য এই সৃষ্টকর্তা। তাঁর ‘সাজানো বাগান’ যেমন মুগ্ধ করেছিল তপন সিনহাকে তেমনি অধ্যাপনার পাশাপাশি ‘শূন্য প্রজাপতি’, ‘নীলা’, ‘সিংহদ্বার’, ‘কেনারাম বেচারাম’ এর চরিত্ররা মুগ্ধ করেছিল আটপৌরে আপামোর বাঙালিকে। মানুষটার হাতধরে বাংলা নাটকের পর্দা উঠেছিলো সানন্দে।’ঘরে বাইরে’,’গণশত্রু’, ‘রাখিপূর্ণিমা’ ,’নায়ক খল নায়ক’ – কৌতুকে-বিষাদে সবেতেই মনোজবাবু অনবদ্য অসামান্য ছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে যারা নাট্যজগতে মনপ্রাণ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মনোজ মিত্র নামটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।আজ তাঁর জন্মদিনে রইল আমার বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তাঁর জীবিতকালে প্রতিবছর বাড়িতে জমজমাট অনুষ্ঠান করে জন্মদিন পালিত হতো। কাটা হতো কেক। বিভিন্ন সময় তাঁর জন্মদিনে এমনকি বাড়িতে অন্যান্য তারকাদের মেলা বসে যেত। উত্তম কুমার থেকে তপন সিনহা,রবি ঘোষ ও বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্বরা তাঁর জন্মদিনে বাড়িতে উপস্থিত থেকেছেন। আজ রবিবার তার জন্মদিনে রবীন্দ্র সদনে এক বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।