
জিন্দেগি ফির ভি ইয়াহাঁ খুবসুরত হ্যায়, গুলজারের জীবনমন্ত্র আনন্দেই মুক্তি
কবি, লেখক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার এবং চলচ্চিত্র পরিচালক সম্পুরন সিং কালরা, ১৮ অগাস্ট ৮৯ বছরে পা দিলেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ পড়ে বাংলা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সেই থেকেই শুরু হয় তাঁর নতুন পথ চলা। উর্দু ছাড়া তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ভাষা ছিল বাংলা। ভালোবাসেন বাংলা ভাষার বই। ভারতের অন্যতম এই জনপ্রিয় কবি, গীতিকার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা সম্পূরন সিং কালরাই হলেন আসলে ‘গুলজার’। এই নামেই তিনি সকলের কাছে পরিচিত। কালরা কে, কেউ জানেন না। কিন্তু গুলজার কে, সকলেই জানেন।
তাঁর লেখা অত্যন্ত জনপ্রিয় বই ‘পান্তাভাতে’র শুরুতেই তিনি নিজের সম্পর্কে লিখেছেন,’ আমি আসলে একজন বাঙালি যে কিনা বাই চান্স জন্মে গেছি একটা পঞ্জাবি পরিবারে। রবীন্দ্রনাথ আমায়, বা আমি রবি ঠাকুরকে পাকড়েছিলাম সেই ক্লাস এইটে। আর তারপর থেকে বাংলা আমার ওপর, না কি আমি বাংলার ওপর ভর করলাম তা ঠিক বলতে পারব না।’ ওই বইতেই তিনি আরও লিখেছেন, ‘হিন্দির টানে ‘গরম চায়ে’ বলার চেয়ে গোল গোল মিষ্টি বাংলায় আমি ‘গরোম চা’ বলতেই বেশি পছন্দ করি।’
ক্লাস টেন পাস করার আগেই রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র পড়ে ফেলেছিলেন গুলজার (Gulzar)। স্কুলে বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলতেন তিনি। তখন থেকেই বাংলা শেখার নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। পরবর্তীকালে স্ত্রীকে প্রেমপত্র লেখার সুবাদে ঝরঝরিয়ে বাংলা লিখতে ও পড়তে শেখেন। ছোটবেলাতেই ঠিক করে ফেলেছিলেন তিনি সাহিত্যিক হবেন।
বিমল রায় এবং রাহুল দেব বর্মনের (আর ডি) সঙ্গে সম্পর্ক ছিল গভীর। আর ডি ভালোবেসে গুল্লু বলে ডাকতেন তাঁকে। গুলজার একটি বইতে লিখেছিলেন, আমি ছিলাম পঞ্চম সুরের ডাস্টবিন। ইচ্ছে ছিল জীবনে একবার অন্তত কাজ করবেন সত্যজিত রায়ের সঙ্গে, বর্তিনের সেই কাজের সুযোগ এলেও কাজ করে হয়ে ওঠেনি নানা কারণে। গীতিকার সলিল চৌধুরীকেও ভালোবাসতেন তিনি। তাঁর ‘পান্তাভাতে’ বইতে সলিল চৌধুরীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি তাঁকে একটু মুখবন্ধ শ্যাম্পেন বোতলের সঙ্গে তুলুন করেন, ‘ফুল অফ এনার্জি।’
একবার সুবোধ ঘোষের ছোটগল্প অনুসরণে নির্মিত ‘ইজাজত’ ছবি তৈরির সময় খুব ভোরে রাহুল দেব বর্মনের বাড়িতে এসে হাজির হন গুলজার। ঘুম চোখে দরজা খুলে রাহুল দেখেন হাতে একটা ছেঁড়া কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আসছেন তিনি। দেখেই প্রমাদ গুনতে শুরু করেন রাহুল। গুলজার তাঁকে বলেন এই গানটায় সুর বসাতে। সারা রাত ধরে তিনি এটি লিখেছেন। পড়ার পরে রাহুল তাঁকে বলেন, তুমি তো এরপর কোনদিন খবরের কাগজের কাটিং এনে বলবে সুর করতে। গানটি ছিল ‘ মেরা কুছ সামান তুমহারে পাশ পড়া হ্যায়….’
ভারতীয় চলচ্চিত্রে ভিন্ন ধারার ছবির জন্ম দিয়েছিলেন গুলজার।বর্তমান পাকিস্তানে তাঁর জন্ম। ভারত ভাগের পর স্বপরিবারে ভারতে চলে আসেন তিনি। সেকারণে মনের ভিতরে দেশভাগের এক অব্যক্ত যন্ত্রণা বসে বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। ‘বন্দিনী’ সিনেমায় শচীনদেব বর্মণের সঙ্গে তাঁর কেরিয়ার শুরু। ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় ‘আঁধি’ সিনেমা নির্মাণ করে কংগ্রেসের রোষানলে পড়েন গুলজার। কিছু দিনের জন্য রাজনৈতিক কলঙ্ক লেপনের চেষ্টার অভিযোগে ছবির প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয়। পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার সহ চলচ্চিত্র ও সাহিত্য জগতের প্রায় সব পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে রয়েছে।
তাঁর নির্মিত ছবি গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘মেরে আপনে’, ‘কোশিস’, ‘মাচিস’ ইত্যাদি। এছাড়া অসংখ্য গান এবং গানের সুর তাঁর দেওয়া। টেলিভিশনেও তিনি সমান দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। প্রখ্যাত উর্দু কবি মির্জা গালিবের জীবনী নিয়ে একটি সিরিয়াল দূরদর্শনের জন্য তৈরি করেন গুলজার। যেখানে অভিনয় করেন নাসিরুদ্দিন শাহের মতো অভিনেতা। পতনোম্মুখ মুঘল সাম্রাজ্যের ভগ্নদশা চলাকালীন ধীরে ধীরে যখন ইংরেজরা দিল্লি সহ ভারতে আধিপত্য বিস্তার করছে সেই সময়ের জীবন্ত ছবি ধরা পড়েছে গালিবের এই জীবনীমূলক সিরিয়ালে। ইতিহাস, রাজনীতি ছিল গুলজারের চলচ্চিত্রের মূল বিষয়। গানের, কবিতায় ভাষা ও সুরে ছিল পাহাড়ি ঝরনার গতি। অত্যন্ত সহজ কথায় গান লিখতে পারতেন, আবার দরবারি উর্দুতেও ছিলেন সাবলীল, সছন্দ। সেলুলয়েডের যুগে রুপোলি পর্দায় জীবনের কবিতা লিখেছেন যিনি তাঁর নাম গুলজার।