Placeholder canvas
কলকাতা মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪ |
K:T:V Clock

Fourth Pillar | সনাতন ধর্ম আর ভারতবর্ষ 

Updated : 9 Sep, 2023 2:30 PM
AE: Samrat Saha
VO: Suchandrima Paul
Edit: Subhadeep Banerjee

“ভগবান বলে কিছু নেই, ভগবান বলে কিছু নেই, ভগবান বলে কিছুই নেই, ভগবান যিনি আবিষ্কার করেছেন তিনি একটি বোকা, যিনি ভগবানের কথা বলে বেড়ান তিনি একজন হতচ্ছাড়া, ভগবানের পুজো যারা করে তারা অসভ্য।” আমি বলছি না, আমি বলছি না, ইন ফ্যাক্ট আমি এটা মনেও করি না। এটা বলতেন এরোডে ভেঙ্কটাপ্পা রামস্বামী পেরিয়ার। উনি আধুনিক সময়ে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠে যুক্তিবাদ, নাস্তিকতার কথা বলতেন, প্রচার করতেন, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রচার করতেন। একটা সময়ে উনি কংগ্রেসেই ছিলেন, তারপর কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে সেলফ রেসপেক্ট মুভমেন্ট শুরু করলেন। বললেন নো গড, নো রিলিজিয়ন, নো গান্ধী, নো কংগ্রেস, নো ব্রাহ্মিণস। এরপর ১৯৩৯-এ জাস্টিস পার্টি শুরু করলেন, ওই একই বিচারধারা নিয়ে। ১৯৪৪-এ স্বাধীন বৃহৎ তামিলভূমির লড়াইকে জুড়ে নিয়ে তৈরি করলেন দ্রাবিড় কজঘম। ওই আন্দোলনের স্বাধীন তামিলভূমির দাবি বাদ দিয়ে বাকি যুক্তিবাদ, নাস্তিকতা, ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধিতা, তামিল ভাষার সংরক্ষণ ইত্যাদি দাবি নিয়ে সি এন আন্নাদুরাই তৈরি করলেন দ্রাবিড় মুন্নেত্র কজঘম, যা ভেঙে আজ ডিএমকে এবং এআইডিএমকে। সেই অর্থে পেরিয়ারের দার্শনিক পটভূমি কতটা শক্ত সেটা বোঝা যায়, কারণ আজও তামিলনাড়ুতে ডিএমকে বা এআইডিএমকে ছাড়া অন্য কোনও দল ক্ষমতায় আসতে পারেনি। অর্থাৎ এরা প্রত্যেকেই ওই পেরিয়ারের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত। করুণানিধি, তাঁর ছেলে স্তালিন বা তাঁর ছেলে উদয়নিধি স্তালিন নাস্তিক, ডিএমকে বা এআইডিএমকে দল হিসেবেও নাস্তিক। তাঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদ, সনাতন হিন্দুপ্রথা, জাতিবাদের বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই লড়ে এসেছেন চিরটাকাল। কাজেই সনাতন ধর্ম নিয়ে উদয়নিধি স্তালিন যা বলেছেন তা নতুন কিছু নয়। তিনি বলেছেন, আমি কোট করছি, “সনাতন ধর্মের প্রথাকে নির্মূল করতে হবে।” উনি বলেননি যে সনাতনীদের কচুকাটা করতে হবে, না একথা বলেননি, বলেছেন সনাতন ধর্মের প্রথাগুলোকে মুছে দিতে হবে। এবং সেটা নিয়েই বিতর্ক। সেই বিতর্কে আসব কিন্তু তার আগে পেরিয়ারের কথায় আসি। 

কাঞ্চিপুরম, বাঙালি যাঁরা বেড়াতে যান বা বাঙালি মহিলাদের জানা আছে কাঞ্চিপুরমের কথা, কাঞ্চিপুরম শাড়ির কথা, সারা দেশ এমনকী বিশ্ব জানে কাঞ্চিপুরম সিল্কের কথা। সেই কাঞ্চিপুরমেই আছে শঙ্করাচার্যের বিখ্যাত মঠ, মঠের উল্টোদিকেই আছে এক মসজিদ, সেটিও বেশ প্রাচীন। মঠের সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ আর মসজিদের আজান মাঝেমধ্যেই মিশে যায়, বা বলা ভালো হরবখতই মিশে যায়। ভক্তদের সারি দু’দিকেই। আর ঠিক মধ্যিখানে উল্টোদিকে রামস্বামী পেরিয়ারের আবক্ষ মূর্তি, যার উপরে লেখা, “ভগবান বলে কিছু নেই, ভগবান বলে কিছু নেই, ভগবান বলে কিছুই নেই, ভগবান যিনি আবিষ্কার করেছেন তিনি একটি বোকা, যিনি ভগবানের কথা বলে বেড়ান তিনি একজন হতচ্ছাড়া, ভগবানের পুজো যারা করে তারা অসভ্য।” হাজার হাজার ভক্ত আসছেন যাচ্ছেন, মন্দিরে বা মসজিদে, মধ্যে পেরিয়ার, উপরে এই কথাগুলো লেখা, সেই কবে থেকে। সম্ভবত ১৯৭৯-এ কয়েকটা হিন্দু সংগঠন মিলে মাদ্রাজ হাইকোর্টে এক মামলা করে। তাদের দাবি ছিল ওই কথাগুলোকে মুছে দেওয়ার। আদালত জানিয়ে দেয়, ওগুলো থাকবে। তখন ফ্রিডম অফ স্পিচের উপরে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত, আজ আবার যদি মামলা হয়, তাহলে আদালত কী রায় দেবে তা আমার জানা নেই। তো এই পেরিয়ার ছিলেন তামিলনাড়ুর রেনেসাঁ পুরুষ। অসংখ্য লেখা, বক্তৃতা আছে, যুক্তিবাদের পক্ষে লড়তে গিয়ে কুসংস্কারের বিরোধিতা করেছেন, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করেছেন, জাতিপ্রথার বিরোধিতা করেছেন, তামিলনাড়ুতে আজও অসংখ্য মন্দির, কিন্তু তার বেশিরভাগেই অব্রাহ্মণ পুরোহিত, এ সবই হয়েছে ওই পেরিয়ারের জন্য। উদয়নিধি স্তালিন যখন সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে এই কামান দাগলেন তখন অন্যদের ভূমিকা কী? কংগ্রেস এবং তৃণমূল খুব সাবধানী প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। কারও ধর্ম আবেগে আঘাত করা উচিত নয় গোছের সাবধানী প্রতিক্রিয়া। মণিপুরের হত্যা, জাতিদাঙ্গা, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মুখে কুলুপ দিয়ে বসে ছিলেন, বসে আছেন। তিনি কিন্তু এ নিয়ে সরব, বলেছেন এর বিফিটিং আনসার, উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। ওদিকে চিদম্বরম-পুত্র কার্তি চিদম্বরম বা খাড়গে পুত্র প্রিয়াঙ্ক খাড়গে কিন্তু উদয়নিধিকে সমর্থনই করেছেন।তাহলে আসুন এবার বুঝে নেওয়া যাক এই সনাতন ধর্ম বিষয়টা কী? 

সনাতন মানে ইটারনাল, সনাতন সত্য মানে ইটারনাল ট্রুথ, সনাতন ধর্ম হল ইটারনাল রিলিজিয়ন। আধুনিক মানুষের ইতিহাস কত পুরনো? তিন লক্ষ বছরের কিছু বেশি। তখন কি কোনও ধর্ম ছিল? ছিল বা ছিল না, কারণ থাকারও কোনও প্রমাণ নেই, আবার না থাকারও কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু এটা বলাই যায় যে বিরাট অঞ্চল, দেশজুড়ে কোনও সংগঠিত ধর্ম ছিল না কারণ মানুষ তখনও ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত। হয়তো এ গোষ্ঠীর মানুষ শেয়ালের মাথাকে দরজায় ঝুলিয়েছে, সেই গোষ্ঠীর মানুষ পেঁচার মাথাকে ঝুলিয়েছে, এরকম কিছু টোটেম বা ট্যাবুর জন্ম হয়ে থাকতে পারে। এদিকে এই বেদ ইত্যাদির ইতিহাস কত পুরনো? গবেষণা বলছে ঋক বেদ কমবেশি ৮০০০ বছরের পুরনো। এবং মজার কথা হল এই ঋক বেদে সনাতন শব্দটাই নেই। তো শব্দটা এল কবে থেকে? গীতায় আমরা এই সনাতন শব্দটা বহুবার পেয়েছি। এই গীতা কত বছরের পুরনো? কমবেশি ৫১৫০ বছরের। সেখানে বহুবার আমরা সনাতন শব্দটাকে পেয়েছি। কী ভাবে? সেখানে কৃষ্ণ অর্জুনকে কিছু শ্বাশ্বত কথা বলছেন, কীরকম? বলছেন, অর্জুন, আত্মার জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না, তাকে দহন করা যায় না ইত্যাদি, বলার পরে বলেছেন এটাই সনাতন। অর্থাৎ এ এক আদিকাল থেকে চলে আসা সত্য। আচ্ছা খেয়াল করুন, উনি কিন্তু বলছেন না যে অনন্তকাল ধরেই এটা চলবে, উনি বারবার বলছেন সনাতন, মানে এ পর্যন্ত চলে আসা সত্য। আমরা বুদ্ধের মুখে এই সনাতন ধর্মের কথা পাই, শ্বাশ্বত সত্যের কথা বৌদ্ধ ধর্ম বলে, তাই বৌদ্ধ ধর্ম সনাতন। বৌদ্ধ ধর্ম কিন্তু ভগবানে বিশ্বাস করে না, কিন্তু তাও সনাতন ধর্ম। একই ভাবে জৈন ধর্মও নিজেকে সনাতন ধর্ম বলে, তা কি হিন্দু ধর্ম? এক্কেবারেই নয়, কারণ জৈন ধর্ম তো পরমাত্মায় বিশ্বাসই করে না, কিন্তু তারাও নিজেদের সনাতন ধর্ম বলে। অর্থাৎ যে ধর্মে সনাতন সত্যের কথা বলা হল, বা এমন কিছু কথা যা দার্শনিক ভাবে আদিকাল থেকে চলে আসা সত্য, তাই সনাতন ধর্ম। কিন্তু সেসবই দার্শনিক পটভূমিকায় সনাতন। এরও বহু পরে হিন্দু ধর্মের বহুবিধ আচার বিচার, মানে প্র্যাকটিস নিয়ে আলোচনা হতে শুরু করল। কিছু মানুষ আজন্ম চলে আসা কিছু আচার বিচারের পরিবর্তন চাইলেন, বা অতীতে ফেলে আসা, মুছে যাওয়া কিছু ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে চাইলেন। ব্রাহ্মণদের বাইরে, ক্ষত্রিয়দের বাইরেও বেদ শিক্ষার কথা বললেন, নারী শিক্ষার কথা বললেন, বংশানুক্রমিক নয়, কাজের ভিত্তিতে জাতিবাদের কথা বললেন। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিল সমাজে, একদল বললেন আমরা সনাতনী, এতদিন ধরে যা চলে এসেছে, যা আমরা মেনে এসেছি, তা পরিবর্তন করতে দেব না। অব্রাহ্মণের মুখে গায়ত্রী মন্ত্র শুনব না, নারীদের স্থান রন্ধনশালায়, রান্নাঘর ছেড়ে তারা পাঠশালায় বেদ শিক্ষা করতে আসবে এ কেমন কথা? আমরা সনাতনী, আমরা ধর্মের মর্যাদা রাখব। শুরু হল সনাতন ধর্মের নতুন ইতিহাস। কত বছর পুরনো? হাজার খানেকও নয়। কিন্তু সমাজের চাপেই ধর্ম পাল্টেছে নিজেকে, আচার বিচার পাল্টেছে। 

ধরুন না দুর্গাপুজোর কথা। সনাতনীদের দুর্গার বর্ণনা আর আজকে সনাতন দিন্দা বা মিন্টু পালের মূর্তি কি এক? ডাকের সাজের দুর্গাই কি সনাতনী? বারোয়ারি পুজো কি সনাতনী? আজকালকার ক’জন ব্রাহ্মণ একাহারী? ক’জন ব্রাহ্মণের ব্রহ্মবিদ্যা জানা আছে? চামড়ার চটি পরতে অস্বীকার করতেন ব্রাহ্মণরা, আজ ক’জন করবেন? বিধবা বিবাহের বিরোধিতা সনাতনীরাই করেছিলেন, আটকাতে পারেননি। মন্দিরে কায়স্থরাই ঢুকতে পারতেন না শূদ্র তো কোন ছার। এখন কটা মন্দির রাখতে পেরেছে সেই শর্ত? এমনকী হিন্দু ধর্মের মধ্যেই শূদ্র জাগরণের কথা বলেছেন বিবেকানন্দ, কোরান পড়েছেন রামকৃষ্ণ, মূর্তিপুজোর বিরোধিতা করেছেন দয়ানন্দ স্বরস্বতী। কোনটা তাহলে সনাতন ধর্ম? হ্যাঁ, এতকিছুর পরেও এই বাংলা থেকেই হিন্দুত্বের কথা উঠেছে সর্বপ্রথম, হিন্দু ধর্মের শুদ্ধতার কথা উঠেছে, সেই কথা গেছে মহারাষ্ট্রে, সেখান থেকেই মনুবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এই সনাতন ধর্মের ধারণা। কীসের সনাতন? যারা হাফ প্যান্টটুকুও বজায় রাখতে পারল না, চামড়ার বেল্ট পরে ফুলপ্যান্ট পরে নিজেদের আধুনিক করে তুলল, যাদের এই প্রজন্ম ধুতি দিলে বড়জোর গামছা বা লুঙ্গির মতো ব্যবহার করবে, তাদের মুখে রোজ শোনা যায় সনাতন ধর্ম। আপাতত যে সনাতন ধর্মের কাজ হল ব্রাহ্মণ্যবাদকে বজায় রাখা, মনুবাদকে বাঁচিয়ে রাখা। উদয়নিধি স্তালিন সেই ব্রাহ্মণ্যবাদকে, সেই মনুবাদকে, সেই তথাকথিত সনাতন ধর্মকে মুছে ফেলার কথা বলেছেন। যে কথা নানক, চৈতন্য, কবির, গুরুচাঁদ ঠাকুর বহু আগেই বলেছেন, যে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়েছেন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবিঠাকুর, বিবেকানন্দ, পেরিয়ার, জ্যোতি রাও ফুলে, বাবাসাহেব আম্বেদকর। আজ রামস্বামী পেরিয়ারের প্রচারের জন্যই দক্ষিণ ভারতের বহু মন্দিরে অনায়াসে শূদ্রদের প্রবেশ সম্ভব হয়েছে, বহু মন্দিরেই আছেন অব্রাহ্মণ পুরোহিত। ওই প্রচারের জন্যই হিন্দু ধর্মের অন্যতম কাঞ্চিপুরম মঠের পাশেই আছে মসজিদ। তাদের সামনেই আছে পেরিয়ারের মূর্তি, যিনি অস্বীকার করেছিলেন ইশ্বরের অস্তিত্বকে মানতে, যিনি যুক্তিবাদের কথা বলেছিলেন। আর সনাতন? সনাতন তো হল সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, তারা, মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস, মানবিক গুণ, ক্ষমা। দয়া, প্রেম, ভালবাসা। সেই আকাশভরা সূর্যতারা প্রাণ খুঁজে যারা পায় না, যাদের মাথায় ভুসো ভরা, তারাই জাতিবাদের কথা বলে, ধর্মে ধর্মে বিরোধের কথা বলে। আজ সনাতন ধর্মের নাম করে যা চলছে তা আদতে এক ভণ্ডামি আর মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়।