Placeholder canvas
কলকাতা রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪ |
K:T:V Clock

Fourth Pillar | দেশ এক বাচাল মেগালোম্যানিয়াকের হাতে

Updated : 14 Sep, 2023 7:03 PM
AE: Samrat Saha
VO: Suchandrima Paul
Edit: Silpika Chatterjee

১৮ তারিখ থেকে সংসদের বিশেষ অধিবেশন, পাঁচদিন ধরে কী আলোচনা হবে তা এখনও সরকার জানায়নি। আসলে মোদিজি জানাননি, জানাতে চাননি, অবোধ শিশুর মতো চমকে দিতে ওঁর ভারি মজা লাগে। মনে নেই? রাত আটটায় আমাদের চমকে দিয়ে নোট বাতিলের ঘোষণা করেছিলেন, মুখে কী অনাবিল হাসি লেগেছিল। সেইরকম আরও বহুবার। আমরা মানে দেশের মানুষজন ভোট দিয়ে সরকার তৈরি করেছি, সরকারের নেতা মোদিজি। আমরা ভেবেছিলাম যাক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার তৈরি হল, এবার সরকার কাজ করবে। কোথায় কী? এসে থেকে ইস্তক উনি আমাদের টাস্ক-এর পর টাস্ক দিয়েই যাচ্ছেন। নোট বাতিল, যাও এটিএম-এ লাইন লাগাও। নতুন ২০০০ টাকার নোট এল, কিছুদিন পরেই যান, গিয়ে ব্যাঙ্কে জমা দিন, কাগজের খাঁজে, বইয়ের মধ্যে, আলমারির কোথাও যদি পড়েও থাকে ১৫ সেপ্টেম্বরের পরে মোদিজির দায়িত্ব নয়। ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দেওয়া হল, যান জিএসটি কলেক্ট করুন, সে যে কী বস্তু তা বুঝতে ছোট ব্যবসায়ীরা আজও নাজেহাল। এবার ঘরের সামনে ঝাড়ু দিন, তারপর গঙ্গা পরিষ্কার করুন, তারপর বাথরুম মানে টয়লেট বানান, কাজ দিয়েই যাচ্ছেন, কাজ করতে আপত্তি নেই, কিন্তু পেটের ভাত কই? চাকরি কই? উনি তখন স্বর্গের পারিজাত কানন পুঁতছেন, আমাদের গ্রাম বাংলায় হুদো হুদো আছে, আদতে শিউলি গাছ, বলছেন গর্ব সে কহো হম হিন্দু হ্যায়। হিন্দু জনতা ভাবছেন, আমার বংশলতিকায় তো সবাই হিন্দু, আজ নয় তার জন্য গর্ব তো অনেক কালের, আমাদের গর্ব আমাদের লক্ষ্মীর পাঁচালির জন্য, দুনিয়া জানে আমাদের দুগগাপুজো, তার জন্য আমরা তো গর্বিতই, হঠাৎ চিল্লিয়ে বলতে হবে কেন? মুসলমান জনসংখ্যা ভাবছেন এ আবার কী কথা? আমরা মুসলমান, খামোখা হিন্দু ধর্ম নিয়ে গর্বিত হওয়ার কারণটা কী? তো যাই হোক এ আলোচনা তো চলবেই, যে কথা বলছিলাম, জানা নেই এখনও কেন বসবে সংসদের অধিবেশন কিন্তু তা বসবে ১৮ তারিখ। এদিকে ১৭ তারিখ বিশ্বকর্মা পুজো। বাংলার বাইরে বিশ্বকর্মা এক বৃদ্ধ ইঞ্জিনিয়ার, আমাদের বাংলায় তা বেশ সুপুরুষ এবং কুচকুচে কালো চুলের দেবতা। ফ্যাক্টরি বহু বন্ধ, কিন্তু তাহলেও রিকশা স্ট্যান্ডেও বিশ্বকর্মার পুজো হয়, এবারে নিশ্চিত জওয়ানের গান বাজবে আর ঝিনচ্যাক নাচ হবে। কিন্তু, হ্যাঁ এখানে এক বিরাট কিন্তু আছে ওই ১৭ তারিখে আবার মোদিজির জন্মদিন। কাজেই কিছু তো একটা করতে হবে, দিনটাকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করাই যেত, কিন্তু অতটা বাড়াবাড়ি এখনই ঠিক নয়। রাম মন্দিরের উদ্বোধন করা যেত, সেও তো জানুয়ারিতে হবে, সব কাজও শেষ নয়, তাহলে? নতুন সংসদ ভবনেরও উদঘাটন উলঙ্গ নগ্নপ্রায় সন্ন্যাসীদের দিয়ে হয়ে গেছে। তাহলে? ওই নতুন ভবনের মাথায় তিরঙ্গা পতাকা ওড়ানো হবে, মানে লহরেগা আর কী। আর সেই পতাকা তুলবেন মোদিজি ছাড়া আর কে? 

অগাস্ট চলে গেছে, এর পরের দান গণতন্ত্র দিবস, সেখানে আবার রাষ্ট্রপতির বড় ভূমিকা, আর ওই গণতন্ত্র শব্দ ইত্যাদি নিজের গায়ে লাগিয়ে রাখতে চান না মোদিজি তাই ওই বিশ্বকর্মা পুজোর দিনেই তিন প্রবেশদ্বারের একটা ওই গজদ্বারে পতাকা তোলা হবে। পতাকা তুলবেন বার্থডে বয় নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি। উদ্বোধন হয়ে যাওয়া সংসদ ভবনে পতাকা উত্তোলন, জানানো হয়েছে দুই কক্ষের বিরোধী দলনেতাদের? বিরোধী নেতাদের? আজ ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৭ তারিখ মোদিজির জন্মদিন পালন করা হবে সেদিন চোখে চোখ রাখনেওয়ালাদের টিভিতে সানাই বাজবে। মোদিজির নাম অমর হয়ে থাকবে। হ্যাঁ এরকমটাই দুনিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা মনে করেন। কিন্তু ভাবুন না আপনি সম্রাট অশোকের জন্মদিন মনে করতে পারবেন, না ঔরঙ্গজেবের, টিপু সুলতানের জানেন? জানেন না আকবরেরও। এটাই সময়, তবুও দাগ রেখে যেতে চান মোদিজি। কিন্তু আমরা তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন ওঁর জন্মদিনেই করতে পারি। দিলাম তালিকা, আপনারা আরও প্রশ্ন জুড়ুন, আরও বিষয় আনুন আর ওই ১৭তে চিৎকার করে বলুন রাজা ঝান্ডা ছেড়ে ভাতের কথা বলো, রাজা ধান্দা ছেড়ে কর্মসংস্থানের কথা বলো। বছরে ২ কোটি করে চাকরির প্রতিশ্রুতি। বেকারত্ব আজ নতুন থেকে নতুনতর রেকর্ড করেই চলেছে, এই জি টোয়েন্টি দেশের ২০টা দেশের তালিকায় সব থেকে পিছনে আমাদের দেশ। দেশে ১০০টি স্মার্ট সিটি তৈরির প্রতিশ্রুতি। একটা স্মার্ট সিটি দেখান কোথাও। কেন হয়নি? আসলে ওই ঘোষণা তো ঘোষণার জন্য ছিল, ঘোষণা হয়েছে নটে গাছটি মুড়িয়েছে।১০০ দিনের মধ্যেই সুইস ব্যাঙ্ক-সহ বিদেশে থাকা সমস্ত কালো টাকা উদ্ধার। টাকা তো আসেইনি, উল্টে আরও টাকা চলে গেছে দেশ থেকে, নিয়ে গেছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে ৯৮ % গুজরাতের ব্যবসায়ী, তাদের মধ্যে অনেকেই মোদিজির পরিচিত।দেশের সমস্ত মানুষের অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। প্রতিশ্রুতি দেবার কিছুদিনের মধ্যেই মোদিজির ছোটা মোটা ভাই অমিত শাহ বলেই দিয়েছেন ওটা ছিল জুমলা, মানে কথার কথা, আসল কথা নয়।রান্নার গ্যাসের দাম কমিয়ে ৩০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি। বাড়িয়ে নিয়ে গেলেন ১১৬০-এ, তারপর ২০০ টাকা কমিয়েছেন, পুজোর সেলের সময় গড়িয়াহাটের দোকানদারেরাও এর চেয়ে বেশি ছাড় দেয়। পেট্রলের দাম লিটারে ৩০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি। এ নিয়ে মোদিজি বহুদিন হল কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছেন, মাঝেমধ্যে বিশ্ব বাজারের কথা বলা হত, এখন তাও বন্ধ।দেশের প্রতিটি কাঁচা বাড়িকে ২০১৯-এর মধ্যে পাকা বাড়ি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। প্রতিটি বাড়িতে পাকা শৌচালয় তৈরি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। কেবল টয়লেট নয়, উসমে নল হোগা, নল মে জল হোগা, ঘর মে বাল্ব হোগা। এখন জানিয়েছেন সেটা ২০৪৭-এর মধ্যে নিশ্চয়ই হবে। নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়া, ললিত মোদি, গৌতম আদানির মতো ৮০ জন লুটেরার কথা, যার মধ্যে ৯৮ % গুজরাতি, আমরা জানি সে সব কথা এবং তাদের একজনও ফেরত আসেনি, ফেরত আনা হচ্ছে না। এরমধ্যে নীরব মোদি জানিয়েছেন ওঁর ঘাড়ে যত টাকার দায় তার বেশিরভাগটাই নাকি উনি বিজেপি ফান্ডে দিয়েছেন। হঠাৎ রাতের বেলায় নোটবন্দি ঘোষণা করে দেশের ১৪৫ কোটি মানুষকে কী ভয়াবহ দুর্গতি ও হয়রানিতে ফেলার সেই রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। না কালো টাকা উদ্ধার হয়েছে, না জাল নোট বন্ধ হয়েছে না উগ্রপন্থা কমেছে। অথচ তিনিই বলেছিলেন নোটবন্দির ৫০ দিনের মধ্যে সমস্ত কালো টাকা উদ্ধারে সফল না হলে জনতার বিচারে চৌরাস্তায় ফাঁসিকাঠে ঝোলার প্রতিশ্রুতি। নোটবন্দি সফল হওয়া তো দূর, ব্যাঙ্ক ও এটিএমের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ১৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু। এবং কালো টাকা চারগুণ বৃদ্ধি।পুলওয়ামা-কাণ্ডে এক বিজেপি নেতা ও পুলিশকর্তার ধরা পড়া আর বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়া আমরা জানি। সৎপাল মালিক সাফ জানিয়েছেন ডাল মে প্রচুর কালা হ্যায়, বলেছেন সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে চুপ করে থাকতে বলেছিলেন, যদিও ওই জওয়ানদের মৃত্যুর জন্য সরকারি গাফিলতিই দায়ী ছিল।উন্নাও, হাথরাস, লখিমপুর খেরি-সহ ত্রিপুরার নারী ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড। সব ঘটনাতেই বিজেপি নেতারা জড়িত কেবল নয়, ধর্ষণের এক সংস্কৃতি বিজেপি নেতারা তৈরি করেছেন। মনে আছে গুজরাতের গর্ভবতী গৃহবধূ বিলকিস বানোর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১১ গণধর্ষককে স্বাধীনতা দিবসে সরকারের মুক্তি দেওয়ার কাণ্ডের কথা। ধর্ষণ, খুনে অভিযুক্তদের সপক্ষে মিছিল করছে বিজেপি। জেল থেকে সেইসব অপরাধীদের ছেড়েই দিল, ছাড়া পাবার পরে তাদেরকে ফুল মালা মিষ্টি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে স্থানীয় বিধায়ক।একদিকে দেশে কোভিড ছড়াচ্ছে, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী এই বাংলায় ব্যস্ত দলের প্রচার করতে। তারপর তো আমরা জানি, সেই ছবি তো আমরা দেখেছি। কোভিডের সময় গঙ্গায় হাজারো মানুষের মৃতদেহ ভেসে ওঠা। ওই সময়েই তাঁর থালি বাজানো, দিয়া জ্বালানোর মতো ভ্যানতারাও আমরা দেখেছি। সঙ্গে ছিল হাজারো কোটি টাকার ভ্যাকসিন কেলেঙ্কারি। আর সেই সুযোগে পিএম কেয়ার ফান্ডের নামে টাকা কামানো।মাঝেমধ্যেই বিজেপি নেতারা, প্রধানমন্ত্রী নিজেই দল এবং তাঁর দলের নেতাদের দুধ কা ধুলা বলেই ব্যাখ্যা করেন, আর বিরোধীরা সব্বাই চোর। বলেনই না আরবিআই কেলেঙ্কারি ও মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম কেলেঙ্কারির কথা। কেন্দ্রীয় সড়ক নির্মাণ যোজনায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি। কর্নাটকে মাইন্স কেলেঙ্কারির কথা, আদানির সাহায্যে দেশের ব্যাঙ্কের কেলেঙ্কারির কথা, না এসব বলেন না।অশীতিপর বয়সের নিরপরাধ ও অসুস্থ সমাজকর্মী ফাদার স্ট্যান স্বামীকে মিথ্যা সাজানো মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার করে মহারাষ্ট্রের জেলে রাখা হল, বিনা বিচারে তিনি মারা গেলেন। শয়ে শয়ে সমাজকর্মী, সাংবাদিক, লেখক, অধ্যাপক আজ জেলে, কারণ তাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন। এবং এখনও জ্বলছে মণিপুর। এই ক’দিনেও লাগাতার খুন হচ্ছেন দু’ পক্ষের মানুষ, মণিপুরের চলতি গৃহযুদ্ধ, হত্যাকাণ্ড, নারীধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লক্ষাধিক মানুষকে গৃহহীন করা ও মহিলাদের নগ্ন করে প্রকাশ্যে প্যারেড করানোর মধ্যযুগীয় কাণ্ড আমাদের চোখের সামনে। মোদিজি ১৭ তারিখ তাঁর জন্মদিন পালন করার জন্য নতুন সংসদ ভবনের গজদ্বারে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন, সম্ভবত এটা আগামীতে রীতি করে তোলারও চেষ্টা হবে, কিন্তু সেদিন এই জরুরি প্রশ্নগুলোও ওই বার্থডে বয়কে করতেই হবে।