Placeholder canvas
কলকাতা রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪ |
K:T:V Clock

Fourth Pillar | প্রাইম মিনিস্টার অফ ভারত, সমস্যাটা কোথায়?

Updated : 9 Sep, 2023 1:31 PM
AE: Samrat Saha
VO: Suchandrima Paul
Edit: Silpika Chatterjee

সম্বিত পাত্র হলেন আমাদের রাজ্যের কুণাল ঘোষ। প্রত্যেক দলের এরকম মুখপত্র থাকে, যাঁদেরকে দিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক তোলানো হয়, বিজেপিতে আছে, কংগ্রেসেও আছে, তৃণমূলে আছে, ডিএমকে-তে আছে। তো সেই সম্বিত পাত্র গতকাল ইস্ট এশিয়া সামিটে দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি নিয়ে এক আমন্ত্রণ পত্রের ছবি দিয়েছেন তাঁর টুইটার হ্যান্ডলে, সেখানে লেখা আছে প্রাইম মিনিস্টার অফ ভারত। এর আগেই মিডিয়ার কাছে পৌঁছেছে জি টোয়েন্টি সামিটের আমন্ত্রণ পত্র, সেখানে লেখা আছে প্রেসিডেন্ট অফ ভারত। এসব সামনে আসতেই আবার আলোচনা শুরু, তাহলে কি মোদি সরকার দেশের নাম পাল্টে দেওয়ার জন্যই ৫ দিনের সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকেছে? পক্ষে বিপক্ষে ধুঁয়াধার ব্যাটিং শুরু হয়ে গেছে, এর মধ্যে আমার পছন্দের সবথেকে ভালো এবং চটজলদি প্রতিক্রিয়া এসেছে আমার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে। তিনি বলেছেন তাতে কী? আমরা তো ইন্ডিয়া ভারত দুটোই বলি তাই না? সত্যিই তো, আমরা রিপাবলিক অফ ইন্ডিয়া বলি, ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ বলি আবার আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বলে ভারত ভাগ্য বিধাতা। আমরা তো অনায়াসেই গাই, যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিল জননী ভারতবর্ষ, সমস্যাটা কোথায়? হ্যাঁ একটা গুরুচণ্ডালী দোষ অবশ্য আছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ভারতের রাষ্ট্রপতি লেখা হলে মানাত ভালো, কিন্তু ওই ভারতের কথাটা আবার সবার বোধগম্য হত না তাই প্রাইম মিনিস্টার অফ ভারত লেখা হল। কিন্তু সম্বিত পাত্র তো সম্বিত পাত্র, তিনি ইন্ডিয়া কথাটার মধ্যে গুলামি খুঁজে পেলেন, বিজেপির ভক্তরাও এই বক্তব্য নিয়েই মাঠে নেমেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিখতে পারছেন না, কারণ বিদেশিদের মুখে ভারত তো তবু এসে যাবে, পোরডানমানটড়ি হয়ে যদি যায়, বা রাসটড়াপাটি, তাহলেই সমস্যা তাই ওখানে প্রেসিডেন্ট আর প্রাইম মিনিস্টার লিখেই সেরেছেন, ওখানে গুলামির গন্ধ তাঁরা পাননি। এ তো গেল এক্কেবারে শুরুর কথা। এবারে আসল কথায় আসা যাক, সমস্যাটা কোথায়? আমন্ত্রণপত্রতে ইন্ডিয়ার জায়গায় ভারত লেখা হয়েছে, আপত্তিটা কোথায়? 

সাধারণভাবে কোনও আপত্তি নেই যদি না বিজেপি সংবিধান থেকে ইন্ডিয়া শব্দটাকেই বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করে। ধরুন একটা সার্কুলার দেওয়া হল, এখন থেকে সরকারি চিঠিপত্র ইত্যাদিতে প্রাইম মিনিস্টার অফ ভারত বা প্রেসিডেন্ট অফ ভারত লিখুন। অনেকে লিখবে, কেউ না লিখলে তার জেল হবে না বা তাকে পিটিয়ে মারা হবে না। কিন্তু যদি ইন্ডিয়া নামটাকেই বাদ দিয়ে দেশের নাম ভারত রাখার চেষ্টা হয়, সেরকম কোনও পরিকল্পনা থাকে, তাহলে সমস্যা আছে বইকী। বিজেপি এবং তাদের মাথা আরএসএস-এর সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত কিছুদিন আগেই বলেছেন ইন্ডিয়া শব্দটা দাসত্বের চিহ্ন বয়ে চলেছে, তাই এই নাম বাদ দিয়ে আমাদের ভারত নামটাই ব্যবহার করা উচিত। আচ্ছা ওঁদের আরেক অভিভাবক গণেশ দামোদর সাভারকর এই ইন্ডিয়া আর ভারত নিয়ে কী বলেছিলেন? উনি বলেছিলেন যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা এক নদী, উনি সিন্ধু নদের কথা বলতে চেয়েছিলেন, সেই নদীর ধারে গড়ে ওঠা এক প্রাচীন সভ্যতা থেকেই আমাদের দেশের নাম ইন্ডিয়া হয়েছে, সিন্ধু থেকে ইন্ডাস, ইন্ডাস থেকে ইন্ডিয়া। সেটাই আমাদের পরিচয়, কবেকার কোন রাজবংশ থেকে তুলে আনা ভারত আমাদের পরিচয় নয়। এদিকে মোদিজির আবার বংশানুক্রমিক শাসনে খুব আপত্তি, দশরথের পুত্র রাম অযোধ্যার রাজা হলে আপত্তি নেই, তাঁদের পূর্বপুরুষ ভরতের নামে ভারত হলেও আপত্তি নেই। এবং মজার কথা হল, এইখানে এসে আরএসএস–বিজেপি, মুসলিম লিগ, জিন্না–গোলওয়ালকর কীভাবে মিলে যায় দেখুন। স্বাধীনতার ঠিক পরেই জিন্নাহ বলেছিলেন, স্বাধীনতা আর দেশবিভাগের ফলে দুটো দেশ জন্ম নেবে, ভারত আর পাকিস্তান। নেহরু গর্জন করেছিলেন, সাফ জানিয়েছিলেন, না তোমাদের দেশ নতুন, তোমাদের দেশের নাম পাকিস্তান, নয়া দেশ, আমরা আমাদের দেশেই আছি, আমাদের দেশ ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত। খেয়াল করুন কেবল জিন্নাহ নয়, তারপর থেকে একমাত্র পাকিস্তান আমাদের ভারত বলেই উল্লেখ করে, তাদের সরকারি নথিতে আমাদের দেশের নাম ভারত। এমনইভাবে এক মৌলবাদ অন্য মৌলবাদের সঙ্গে মিলে যায়। থাক সে কথা আবার আমাদের মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। 

এমনিতে ইন্ডিয়ার জায়গায় ভারত বা ভারতের জায়গায় ইন্ডিয়া বসালে তো কোনও আপত্তি হওয়ার কথা নয়, আমরা অনায়াসে ভারতীয় বলে গর্ববোধ করি, অসম্ভব ভাষা বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও ইন্ডিয়ানাট্যম নয়, নাচটির নাম ভারত নাট্যমই আছে, তামিল মানুষজন সেটাই বলেন। আবার আমরা ইসরো, ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বলি, অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স বলি, ভারতীয় সঞ্চার নিগম লিমিটেড বলি। কিন্তু যদি ইন্ডিয়া শব্দটাকেই মুছে দিতে হয়? তাহলে প্রবল বিরোধিতা উঠবে দক্ষিণ থেকে, উত্তরের বহু অংশে, উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে। এবং শুধু বিরোধিতাই নয়, আবার আমাদের কারেন্সি নোট নতুন করে ছাপতে হবে, পাসপোর্ট থেকে আধার কার্ড থেকে প্যান কার্ড থেকে ভোটার কার্ড বদলাতে হবে, কত টাকা খরচ হবে? খুব সাধারণ ধারণা হল দেড় লক্ষ কোটি টাকা, এর সঙ্গে সরকারি নথি, দফতর ইত্যাদির নাম বদলাতে হলে আরও ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। তার মানে ইন্ডিয়া নাম বাতিল করা হলে দেশের ওপর চাপবে অতিরিক্ত ২ লক্ষ কোটি টাকার দায়। এরপরে আছে পদ্ধতি। এই নাম বদলাতে হলে সংবিধানের ঘোষণাপত্র থেকে সংবিধানের কম করেও ৩০-৪০টা সংশোধনী আনতে হবে। কেবল তাই নয়, এ বিল রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা থেকেও পাশ করাতে হবে, লোকসভা, রাজ্যসভা তো বটেই। আচ্ছা এসব কি মোদি–শাহ, আরএসএস–বিজেপি জানে না? বিলক্ষণ জানেন, আমার আপনার থেকে কিছুটা বেশিই জানেন যে এক্কেবারে সংবিধান ও দেশের কাঁথায় আগুন না লাগিয়ে এই পরিবর্তন করা যাবে না। আর সংসদে পাঁচ দিনের অধিবেশন ডেকে তো সম্ভবই নয়। তাহলে এটা করছেন কেন? এটা করছেন দুটো কারণে, ওঁরা জল মাপছেন, ওঁরা খোলনলচে পাল্টে এক নতুন হিন্দুরাষ্ট্রের পথেই চলতে চান, এগুলো তার ছোট ছোট টেস্ট, কতটা সহ্য করবে মানুষ? কীভাবে রি-অ্যাক্ট করবে মানুষ? রাজনৈতিক দল, ইন্টলিজেন্সিয়া, সংবাদমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? এসব দেখে নিতে চাইছেন। রাজপথকে কর্তব্য পথ করা হল,  নতুন সংসদ ভবন হল, হিন্দু উপাচারে যজ্ঞ করে, হিন্দু রাজাদের মতো রাজদণ্ড আর সন্ন্যাসীদের এনে হিন্দু হৃদয়সম্রাট হওয়ার চেষ্টা, পুজোআচ্চা করে ভারত মণ্ডপম তৈরি হল যেখানে জি২০ বৈঠক হবে। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডকে বদলে ভারতীয় ন্যায়সংহিতা করা হল। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক পরামর্শদাতা কমিটির সদস্য বললেন নতুন সংবিধান লেখার সময় এসেছে, তার আগেই সংসদে দাঁড়িয়েই প্রাক্তন চিফ জাস্টিস অফ ইন্ডিয়া, রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য বললেন সংবিধানে মূল কাঠামো বলে কিছুই হয় না, সবটাই সংশোধন করা যায়। এরপর এল এক দেশ এক নির্বাচনের কথা, তারপর এই ইন্ডিয়া নাকি কলোনিয়াল হ্যাংওভার, তাই নতুন নাম ভারত। আসলে মোদিজি বুঝতে পারছেন, আরএসএস–বিজেপি বুঝতে পারছে শতবর্ষের মুখে দাঁড়িয়ে, ১৯২৫-এ হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার শপথ নেওয়ার ১০০ বছরের মধ্যে হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনার এতটা কাছে এসেও হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে সুযোগ। তার কারণ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে ব্যর্থ এই সরকার, মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্বের থাবায় আম আদমির জীবন এখন নরক, তাকে কল্পিত হিন্দুরাষ্ট্র আর সেই রাষ্ট্রে বহতা দুধের ধারার গল্পে ভুলিয়ে রাখা অসম্ভব। তার ওপরে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত বিরোধীরা জোট বাঁধছে। জুড়েগা ইন্ডিয়া, জিতেগা ভারত স্লোগানের সামনে এক নি-জার্ক রি-অ্যাকশন দেখছি আমরা। হঠাৎই তূণীর থেকে যত অস্ত্র ছিল সব বের করে শেষ আক্রমণে নেমেছে আরএসএস–বিজেপি। 

এই শক্তিকে রুখতে পারে এক ঐক্যবদ্ধ বিরোধী জোট, এক ঐকবদ্ধ ভারত, যে ভারত শাশ্বত চেতনার কথা বলে, বলে বসুধৈব কুটুম্বকম, যে ভারতবর্ষের ভুনাওলার উনুনের পাশ থেকে এক সন্ন্যাসী দেখেছিলেন দরিদ্র, চণ্ডাল, মুচি ভারতবাসীর উত্থান। এক কবি দার্শনিক বলেছিলেন, শক হুন পাঠান মোগলের এক দেহে লীন হয়ে যাওয়ার কথা, এক বিরাট প্রাজ্ঞ পণ্ডিত মানুষের দল দীর্ঘ দু’ বছর আলোচনার পরে লিখেছিলেন উই দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়ার জন্য এক নতুন ঝকঝকে সংবিধান। মুঘল সম্রাটের তৈরি লালকেল্লার প্রাঙ্গণ থেকেই ভারত ভাগ্যবিধাতার গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল। আজ সেই মূল কাঠামো ধরেই নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছেন মোদিজি। এখনও নানান বিভেদের জালে আটকে সম্মিলিত প্রতিরোধে না নামলে প্রশ্ন তো উঠবেই, 

তা যদি না হয় মাথার উপরে ভয়ঙ্কর
বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর;
তা যদি না হয়, বুঝব তুমি মানুষ নও-
গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও।
ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয়নি জল?
দেয়নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল?
পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই
ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই।।