Aajke | বিচিত্র এই রাজ্যপাল কী করতে চাইছেন?
এক শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলায় মগ্ন আমাদের রাজ্যপাল। উনি কারও সঙ্গে কথা বলবেন না, উনি কারও সঙ্গে আলোচনাও করতে রাজি নন। উনি ঠিক করেছেন রাজ্যের বচাকুচা শিক্ষার কাঠামোটিকে এক্কেবারে জলাঞ্জলি না দিয়ে থামবেন না। অন্য প্রত্যেক হিজ মাস্টার্স ভয়েজ রাজ্যপালের সঙ্গে এঁর তফাত হল ইনি নিজের কাজকর্মের কোনও ব্যাখ্যাও দিতে রাজি নন। কীসের ভিত্তিতে তিনি শিক্ষা দফতরের প্রতিটি কাজে হস্তক্ষেপ করছেন, কোন আইনে তিনি নিজেই আচার্য হচ্ছেন, তারপর উপাচার্যও হচ্ছেন, কোন আইনের ধারা বলে রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সঙ্গে বিন্দুমাত্র আলোচনা না করেই তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করছেন, এ নিয়ে তিনি কোনও আলাপচারিতাতে যেতে রাজি নন। এ নিয়ে তিনি কোনও প্রশ্নের জবাব দিতেও রাজি নন, এমন এক বিচিত্র অবস্থায় আমরা উদ্ধার করলাম যে আমাদের এই গাঁয়ে না মানে আপনি মোড়ল রাজ্যপালের পুরো নাম হল চিত্রম বিচিত্রম আনন্দ বোস, নাম জানা গেলেও তাঁর এই বিচিত্র ভূমিকার কোনও ব্যখ্যা আমরা এখনও পাইনি। এমনিতে ধরুন আপনার জমিদারি, সেখানে আপনার প্রজাদের খাজনা আদায়ের জন্য আপনি শ্যামচাঁদ না কালাচাঁদ কাকে বহাল করবেন তা তো আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এই বাংলা তো হিজ হাইনেস চিত্রম বিচিত্রম আনন্দ বোসের জমিনদারি নয়, কাজেই তাঁর কাজের জবাবদিহি তো আমরা চাইতেই পারি। বিশেষ করে আমাদেরই রাজ্যের প্রাইম লোকেশনে ২৭ একর জায়গা জুড়ে রাজ্যের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যের ৬০ কামরার বড় প্রাসাদে বসে আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় এমনকী চা বিস্কুট খেয়ে কেউ একজন যদি আমাদেরই রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা তছনছ করেন, অন্তত তেমন অভিযোগ যদি তাঁর বিরুদ্ধে তোলা হয়, তাহলে আমাদেরও হক জন্মায় যে চিত্রম বিচিত্রমবাবুকে এ নিয়ে দু’ চারটে সাধারণ প্রশ্ন করা এবং তার জবাব চাওয়া। আজ সেটাই বিষয় আজকে, বিচিত্র এই রাজ্যপাল কী করতে চাইছেন?
প্রথমত তিনি শিক্ষকদের এক বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠনের মানুষজনকে তুলে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় উপাচার্য করে বসাচ্ছেন। তাঁদের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারের কৃশ চেহারা তাঁর বিবেচনায় আসছে না, তিনি কেবল দেখছেন মানুষগুলি যেভাবেই হোক যেন পদ্ম গন্ধ সুরভিত হন, ব্যস, সেটাই একমাত্র ক্রাইটেরিয়া। এখন সমস্যা হল তেমন মানুষজনও আমাদের রাজ্যে বড্ড কম, শিক্ষাক্ষেত্রে আরও কম, কাজেই এরপর তাঁর নজর জি হুজুর বান্দাদের দিকে। তাঁদেরও তুলে আনা হচ্ছে, শিক্ষাজগতের বাইরে থেকে এক চিফ জাস্টিস, কর্নাটক হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত চিফ জাস্টিস শুভ্রকমল মুখার্জিকে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করে দেওয়া হল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী ঠিকই বলেছেন, এরপরে কি এই যুক্তি মেনে প্রাক্তন উপাচার্যকে চিফ জাস্টিস করা হবে?
রাজ্যপাল তাঁর পদমর্যাদা বলে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য। হ্যাঁ, এর আগে আমরা মাধ্যমিক পাশ রাজ্যপালও দেখেছি, অত্যন্ত শিক্ষিত রাজ্যপালও দেখেছি। মহাত্মা গান্ধীর প্রপৌত্র গোপালকৃষ্ণ গান্ধীকেও দেখেছি, কিন্তু এরকম আচার্যপনা দেখিনি, তাঁরা করেননি কারণ একে তো শিক্ষা রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়, পরে উচ্চশিক্ষা যুগ্ম তালিকায় আনা হয়। আপাতত সেই নিয়ম মেনেই উচ্চশিক্ষায় দিল্লির সরকার মোড়লগিরি করেই যাচ্ছেন, তার ওপরে যোগ দিলেন এই রাজ্যপাল। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইনে দেবে কে? রাজ্য সরকার। অশিক্ষক কর্মচারীদের মাইনে দেবে কে? রাজ্য সরকার। ভবন মেরামতি, বিভিন্ন পরিকাঠামোর খরচ জোগাবে কে? রাজ্য সরকার। ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অ্যাকটিভিটিজ-এর পয়সা কে জোগাবে? রাজ্য সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় সুরক্ষা, আইন শৃঙ্খলা কার দায়িত্বে? রাজ্য সরকারের। মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাবেন কে? চিত্রম বিচিত্রম আনন্দ বোস। কী আনন্দের কথা। কাজেই যা হওয়ার ছিল তাই শুরু হয়ে গেছে, মুখ্যমন্ত্রী সাফ জানিয়েছেন এরকম চলতে থাকলে আমরা শিক্ষক কর্মচারীদের মাইনে দেওয়া বন্ধ করব, তাঁরা যান উপাচার্য কিংবা আচার্যের কাছে। অর্থাৎ সম্মুখ সমর। অর্থাৎ রাজ্যের নির্বাচিত প্রধান জানালেন দিস ফার অ্যান্ড নো ফার্দার। কিন্তু সেই রাতেই আমাদের চিত্রম বিচিত্রম বাবু আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় আরেকজন উপাচার্যকে বসানোর নির্দেশ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন আমি কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো, তোরা যা করার কর। এ কি গণতন্ত্রে চলতে পারে নাকি? আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সাফ জানিয়েছেন, গভর্নর যদি তাঁর খেয়াল খুশি মতন উপাচার্য নিয়োগ করতে থাকেন তাহলে শিক্ষক কর্মচারীদের মাইনের ব্যবস্থাও তাঁকেই করতে হবে। সরকার পয়সা জোগাবে আর রাজ্যপাল তাঁর খেয়ালখুশি মতন নিয়োগ করেই যাবেন এ হতে পারে না, আপনারা এই বক্তব্যের সঙ্গে কি সহমত? শুনুন কী বলেছেন আমাদের দর্শকেরা।
আসলে ছোটবেলাকার অতৃপ্তি একটা বয়সে ঘাড়ে চাপে, সুযোগ আর সুবিধে পেলেই তা পল্লবিত হয়। কারও নাচার ইচ্ছে জাগে, কারও ইচ্ছে হয় বেড়ানোর, দেখব এবার জগৎটাকে, কারও ইচ্ছে হয় আত্মজীবনী লেখার। তেমনিই কারও কারও ইচ্ছে হয় নিজের ক্ষমতা জাহির করার, ছোট্টবেলায় সহপাঠীদের বোম্বাইয়া খেতে হয়েছে, সেই যে পেছন থেকে লুকিয়ে মাথার ওপর চাঁটি। টিফিনবক্স খুলে দেখতে হয়েছে খাবার নেই, কারা যেন খেয়ে নিয়েছে, এসব ইত্যাকার সহজ র্যাগিংও মনে জন্ম দেয় এক প্রতিশোধ স্পৃহার, বড় হয়ে আমিও আমার ক্ষমতার প্রয়োগ করব। আমাদের চিত্রম বিচিত্রম বাবু কি সেই রোগে আক্রান্ত? উনি কেন কালাপাহাড়ের মতো আমাদের উচ্চশিক্ষার কাঠামোটাকে ভাঙতে চান তা সত্যিই গবেষণার বিষয়।